Description
এই লেখা অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনার অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে লেখা হলেও তা ‘আত্মকাহিনি’ নয় কখনোই। এখানে ঘটনা ও কল্পনা, যথা সুরা ও সচেতন জল। কোথাও ঘটনা ও চরিত্রের উপর কল্পনার প্রলেপ দিয়ে তৈরি হয়েছে অন্য একটি কল্পচরিত্র। এই আখ্যানে অতীত আর বর্তমান দুটি লাইন পাতা রয়েছে সমান্তরাল। বর্তমান মানে সে-ও তিরিশ বছর পূর্বের এক অতীত। বানিয়ে বললে বলতে হয় এ হল বাইরের আর ভিতরের সমান্তরাল দুটি পথ। এ হল সেই পথের গল্প।
অংশুমান কর্মকার –
বইমেলা থেকে ফিরে গোগ্রাসে পড়ে ফেললাম একটি পুস্তক, প্রিয় কবি কৌশিক বাজারীর লেখা একটি গ্রন্থ, গ্রন্থ বা পুস্তকই বললাম, কেনোনা এই পুস্তক বা গ্রন্থটিকে কোন পর্যায়ে ফেলবো বুঝতে পারলাম না। এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে টানটান রচনাশৈলী যা শুরু করার পর শেষ না করে উঠতে দেয় না , সেক্ষেত্রে একে উপন্যাস বলা যায় ।এই লেখার কাব্যময়তা সুমধুর স্মৃতিকে এক কবিমনের অজানা ভুবনে নিয়ে যায়- “আজ আবার অনেকদিন পর এই টিনের ছাদের ঘরে একা শোয়া হবে। যদি আজ রাতে বৃষ্টি নামে, নামবে কি? যদি নামে, তাহলে একটানা তার ধারাবর্ষণ টিনের চালের উপরে যে লহরা তোলে , তা সারারাতের ঘুম কেড়ে নেবে, বুকের ভেতরের গুমগুমের সঙ্গে মিশে যাবে মেঘডাকা।” তাই এই লেখনীকে সুদীর্ঘ কবিতাও বলা যায়। এই লেখার সাথে কবি অঙ্গাঙ্গীভাবে এতটাই মিশে আছে যে একে টাটকা আত্মজীবনের অংশও বলা যেতে পারে। এই পুস্তকটিতে বিহারের কয়েকটি জেলার বেশ কিছু গাঁ-গঞ্জে লেখক আমাদের এক অলৌকিক ভ্রমনের দিকে নিয়ে গেছেন চিনিয়েছেন হাতের তালুর মতো -” কোলিয়ারি অঞ্চল কয়লার আস্তরনে ঢাকা ছড়ানো বস্তি,গায়ে গায়ে লাগানো ঘর। বেড়ার গায়ে কাঁথা -কাপড় শুকাচ্ছে। ন্যংটোবাচ্চা খেলছে উঠানে…” তাই একে সুনিবিড় ভ্রমণকাহিনীও বলা যেতে পারে। গল্প বলতে লেখক যেভাবে ফ্ল্যাশব্যাকে গিয়ে আমাদের বাংলার ১০০- ১৫০ বছর পিছনের গাঁ-গঞ্জের যে বর্ননা দিয়েছেন তা যেনো চোখের সামনে ভাসে। আমদের সুদূর অতীতে এক গঞ্জের যুবকের খালিহাতে বাঘ শিকারের যে গল্প আমাদের বলেছেন তা পড়তে সত্যিই রোমাঞ্চকর লাগে। আমাদের মস্তিষ্কের প্রত্যেকটি পরতকে নিয়ে খেলেছেন এই লেখক আমাদের কখনো নিয়ে গেছেন এক জোনাকিগাছের তলায় যেখানে ভুতেরা রাস্তাজুড়ে ঘুরে বেড়ায় আবার কখনো নিয়ে গেছেন কয়লার ধুলোমাখা কায়লার খাদান থেকে গাঁইতি হাতে উঠে আসা প্রস্তরযুগের হোমো-স্যপিয়েন্স।
ভাষার কথা বলতে গেলে বলতে হয়, মুলত চারটি ভাষা এখানে পাশাপাশি চলেছে,- খাঁটি বাঁকুড়ার ভাষা, বাংলার মান্য ভাষা এবং ঝারখণ্ডি খোট্টাইস ভাষা ও ভোজপুরী ভাষা, যার যেখানে প্রয়োজন হয়েছে বসে পড়েছে।- এ হে কিছকে রে?
– ই ফেরি কা সামান আইলা।
– কাঁ সে আইলা রে?
– বঙ্গাল সে…
শেষে একটা কথা বলা যায়, এই ধরনের লেখা বাংলা ভাষায় দুর্লভ বললেও অত্যুক্তি হবে না। বাংলা ভাষার পাঠক এই পুস্তকখানি না পাঠ করলে মিস করবেন অনেককিছু। যা এই পুস্তকের পরতে পরতে রয়েছে।এই পুস্তকের প্রতিটি শব্দ মুক্তোর মতো ছড়িয়ে দিয়েছেন লেখক,পাঠকের কুড়িয়ে নেবার অপেক্ষায়।
পরিশেষে আমি ক্ষুদ্র পাঠক হিসেবে এটুকুই বলবো সমান্তরাল অনেকগুলি পথকে লেখক বেঁধে ফেলেছেন এক সুত্রে।
এই পুস্তকটিতে অলংকরণ গুলিও লেখার সাথে সাথে ছড়িয়ে আছে যখন যেমনটি দরকার তেমনভাবেই সেজন্য অলংকরণ শিল্পী সজল কাইতিকেও মনে থাকবে অনেকদিন। সর্বোপরি প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায় একটা দারুন প্রছদ করেছেন।এত সুন্দর একটি লেখাকে সুন্দর ছাপাই ভালো কাগজ দিয়ে পুস্তকের আকারে আমাদের কাছে পরিবেশন করার জন্য ধানসিড়ির শুভ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ দিয়ে এই ক্ষুদ্র আলোচনা শেষ করছি।
ফেরিওয়ালার ডায়েরি
রচনা- কৌশিক বাজারী
প্রকাশক – ধানসিড়ি
মুদ্রিত মুল্য- ২৭৫ টাকা